সর্বশেষ

6/recent/ticker-posts

Header Ads Widget

 সুন্দরবনের হুমকিগুলো নিয়ন্ত্রণ করা প্রয়োজন

বিধান চন্দ্র দাস

১৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩

kalerkantho

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের বিখ্যাত রূপক চরিত্র ‘ব্যাঘ্রাচার্য্য বৃহল্লাঙ্গূল’-এর মুখ দিয়ে বলা, ‘হে মাতঃ সুন্দরবন! আমি কি তোমাকে কখনো ভুলিতে পারিব?’ কথাটি খুবই তাৎপর্যময়। একটি বাঘের মুখ দিয়ে কথাটি বলা হলেও সুন্দরবনের বিচিত্র সৌন্দর্য ও ঐশ্বর্য যিনি উপলব্ধি করেছেন, তাঁর পক্ষে এই অরণ্যকে ভুলে যাওয়া সত্যিই অসম্ভব। বিখ্যাত ইংরেজ কবি ও ‘পোয়েট লরিয়েট’ (১৯৮৪ সালে ইংল্যান্ডের রানি কর্তৃক এই সম্মানসূচক পদে নিযুক্ত) টেড হিউজ (১৯৩০-৯৮) ১৯৮৯ সালে সুন্দরবনে অবস্থানকালে কয়েকটি কবিতা লিখেছিলেন। সুন্দরবনের মোহনীয় সৌন্দর্য মূর্ত হয়ে উঠেছে তাঁর কবিতায়।



প্রকৃতপক্ষে হৃদয়ের গভীর ক্যামেরা ছাড়া সুন্দরবনের সৌন্দর্য ধরে রাখা যায় না। অগণিত-অসংখ্য নিউরনের লাখো কোটি বিন্যাসে সুন্দরবন মানবমনের গভীরে যে সৌন্দর্য সৃষ্টি করে, সাধ্য কী প্রাণহীন যন্ত্র তা ধরে রাখে? আর সে কারণেই সুন্দরবনের অন্তর্নিহিত ঐশ্বর্য, যার চৈতন্যে যত বেশি আঁচড় কাটে, তিনি তত বেশি মুগ্ধ হন। আবিষ্ট হন। বাকি জীবন বয়ে বেড়ান এক অনির্বচনীয় সুখ-জাগানিয়া স্মৃতি। কবি-সাহিত্যিক-শিল্পী বারবার সেই স্মৃতির ঝাঁপিতে ডুব দেন। সুন্দরবনকে মূর্ত করে তোলার চেষ্টা করেন শব্দ কিংবা তুলির আঁচড়ে।

কিন্তু সুন্দরবন কী শুধুই সৌন্দর্য উপভোগের জায়গা? এই বনের অন্য কোনো কি মূল্য নেই? চোখ-জুড়ানো বিশাল এই অরণ্যের বাস্তুতান্ত্রিক মূল্য কতখানি? আমাদের জীবন-জীবিকা তথা পরিবেশের ওপর সুন্দরবনের ব্যাপক ও বিশাল প্রভাব আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় এই বনের বাস্তুতান্ত্রিক সেবাগুলোর অপরিহার্যতা। বিজ্ঞানীরা সুন্দরবনের সেবাগুলোকে প্রধানত চার ভাগে ভাগ করেছেন। এগুলো হচ্ছে—১. বস্তুগতসেবা : এই বনের প্রাণী ও উদ্ভিদ থেকে প্রাপ্ত খাদ্য, ওষুধ কিংবা অন্যান্য সামগ্রী, ২. নিয়ামকসেবা : কার্বন জমাকরণ ও জলবায়ু নিয়ন্ত্রণ, পরাগায়ণ, মৃত্তিকা ক্ষয়রোধ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ (ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস) থেকে রক্ষা ইত্যাদি, ৩. সহায়তাসেবা : মৃত্তিকা তৈরি, অক্সিজেন উৎপাদন, পুষ্টি আবর্তন ইত্যাদি এবং ৪. সাংস্কৃতিকসেবা : আধ্যাত্মিক প্রশান্তি, চিত্তবিনোদন, পর্যটন, শিক্ষা ইত্যাদি। সুন্দরবন থেকে প্রাপ্ত এই চারটি সেবা অন্যান্য যেকোনো বনের তুলনায় তাৎপর্যপূর্ণ। বিশেষ করে এই বন তার নিয়ামকসেবা (কার্বন জমাকরণ ও জলবায়ু নিয়ন্ত্রণ) ও সহায়তাসেবা (অক্সিজেন উৎপাদন, পুষ্টি আবর্তন) প্রদানের মাধ্যমে গোটা পৃথিবীর জন্য এক বড় সম্পদ হিসেবে বিবেচিত হয়েছে।

সুন্দরবনের অনন্য বৈশিষ্ট্যের কারণে ইউনেসকোর বিশ্ব ঐতিহ্য কেন্দ্র ১৯৯৭ সালে সুন্দরবনকে বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। এই স্বীকৃতি পাওয়ার জন্য ইউনেসকোর মোট ১০টি শর্তের মধ্যে যেকোনো একটি শর্ত পূরণ করার প্রয়োজন ছিল। কিন্তু সুন্দরবন একটির জায়গায় দুটি শর্ত অর্থাৎ শর্ত নম্বর ‘৯’ ও ‘১০’ পূরণ করেছিল। ইউনেসকোর ৯ নম্বর শর্তটি হচ্ছে : ‘স্থলজ, মিঠা পানি, উপকূলীয় ও সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্র এবং উদ্ভিদ ও প্রাণী সম্প্রদায়ের বিবর্তন ও বিকাশে বাস্তুতাত্ত্বিক ও জীবতাত্ত্বিক তাৎপর্যপূর্ণ অবিরাম প্রক্রিয়াসংবলিত অসামান্য উদাহরণ হতে হবে।’ তাদের ১০ নম্বর শর্তটি হচ্ছে : ‘খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যপূর্ণ প্রাকৃতিক বাসস্থান হতে হবে, বিজ্ঞান অথবা সংরক্ষণের দৃষ্টিকোণ থেকে বৈশ্বিকভাবে মূল্যবান হুমকিগ্রস্ত প্রজাতিসহ জীববৈচিত্র্যের স্বস্থানিক (ইন সিটু) সংরক্ষণ যেখানে সম্ভব হবে।’

তবে বিশ্ব ঐতিহ্য কেন্দ্রের ‘কনভেনশন’ অনুযায়ী কোনো ভুক্তিই চিরস্থায়ী নয়। তালিকাভুক্ত যেকোনো স্থানের বিশ্ব ঐতিহ্য কেন্দ্র প্রণীত শর্ত অর্থাৎ বৈশিষ্ট্য নষ্ট হয়ে গেলে তাকে প্রথমে ‘বিপদাপন্ন স্থান’ হিসেবে ঘোষণা করা হয় ও তা পূরণ করার জন্য সময় দেওয়া হয়। এরপর নির্দিষ্ট সেই সময়ের মধ্যে তা পূরণ করতে ব্যর্থ হলে তখন সেই স্থানকে তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়। ‘কনভেনশন’ (১৯৭২) ও এর ‘বাস্তবায়ন নির্দেশিকায় (২০২১) বিশ্ব ঐতিহ্য কেন্দ্র বিপদগ্রস্ত হওয়ার জন্য অনেক কারণ চিহ্নিত করা হয়েছে। সেগুলোর মধ্যে সুন্দরবনের বাস্তবতায় প্রাকৃতিক দুর্যোগ, জলবায়ু পরিবর্তন, দূষণ, কাঠপাচার, চোরাশিকার, আগ্রাসী প্রজাতি বিস্তার, প্রজাতিসংখ্যা হ্রাস পাওয়া, পর্যটন ইত্যাদিকে বিবেচনায় নেওয়া প্রয়োজন।

বাংলাদেশ ও ভারতীয় সুন্দরবনের ওপর পরিচালিত পৃথক গবেষণায় দেখা গেছে, সুন্দরবনের এই দুই অংশেই নানা ধরনের হুমকি তৈরি হয়েছে। বিশেষ করে ঘন ঘন প্রাকৃতিক দুর্যোগ (ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস), দূষণ, লবণাক্ততা, নদী/খালগুলো পলিতে ভরাট হয়ে যাওয়া, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, অতি আহরণ ইত্যাদি বিষয় দুই দেশের সুন্দরবন বাস্তুতন্ত্র (ম্যানগ্রোভ বাস্তুতন্ত্র)-এর জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। গত বছর (২০২২) এলসিভিয়ার গ্রুপের একটি জার্নালে প্রকাশিত ভারত-বাংলাদেশের মোট আটজন বিজ্ঞানী (ভারতের সাতজন ও বাংলাদেশের একজন) এক গবেষণা প্রবন্ধে ভারত ও বাংলাদেশের বিভিন্ন নদী দিয়ে বছরে ৪০ লাখ টন মাইক্রোপ্লাস্টিকস সুন্দরবন ও বঙ্গোপসাগের গিয়ে পড়ছে বলে উল্লেখ করেছেন। এই প্রবন্ধে সুন্দরবনের খাদ্য শৃঙ্খলে মাইক্রোপ্লাস্টিক ঢুকে সেখানকার বিভিন্ন জীব প্রজাতির জন্য হুমকি সৃষ্টি করেছে বলে বলা হয়েছে।

বাংলাদেশ, চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের কয়েকজন গবেষকের লেখা একটি প্রবন্ধে (২০২২) বাংলাদেশ সুন্দরবন অংশে বাঘ শিকারসংক্রান্ত একটি চমৎকার গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশ করা হয়েছে। ১৯৮০ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত সুন্দরবনের ডাকাত বা দস্যুরাই মূলত বাঘ ও অন্য প্রাণীদের শিকার করত। ২০১৮ সালে ডাকাতদের গণ-আত্মসমর্পণের পর সুন্দরবনের চোরাশিকার অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। কিন্তু একেবারেই তা নির্মূল করা যায়নি। কারণ উল্লিখিত ওই প্রবন্ধে সুন্দরবনকে ঘিরে থাকা ২৬টি ইউনিয়নের মোট ৩৪১ জন বাঘ শিকারি এখনো সক্রিয় আছে বলে দাবি করা হয়েছে। গত ২৩ ডিসেম্বর ২০২২ তারিখে ‘সুন্দরবনের দস্যুরা নতুন করে মাথাচাড়া দিতে শুরু করেছে’ বলে ‘বিবিসি বাংলা’ এক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। বিষয়টি বিবেচনায় নেওয়া প্রয়োজন।

সুন্দরবনের অন্য হুমকিগুলো, বিশেষ করে দূষণ, লবণাক্ততা, আগ্রাসী প্রজাতি বিস্তার, প্রজাতিসংখ্যা হ্রাস পাওয়া ইত্যাদি বিষয় নিয়ন্ত্রণের জন্য নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করা প্রয়োজন। ইউনেসকোর বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান সম্পর্কিত ‘কনভেনশন বাস্তবায়ন নির্দেশিকার (২০২১)’ অনেক জায়গায় [যেমন—অনুচ্ছেদ নম্বর ১৩২(৬)] হুমকিসংক্রান্ত নিয়মিত পর্যবেক্ষণের বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে। সদ্যঃসমাপ্ত কপ-১৫-এর আন্তর্জাতিক জীববৈচিত্র্য রক্ষা চুক্তির বিভিন্ন ধারায়ও উপরোক্ত বিষয়গুলোসহ নিয়মিত পর্যবেক্ষণের ওপরও গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, সুন্দরবনের জন্য এই কাজগুলো কারা করবেন? বন বিভাগে সেই ধরনের বিভিন্ন বিষয়ে দক্ষ ও স্থায়ী জনবল আছে কি না? দূষণ, লবণাক্ততা, আগ্রাসী প্রজাতির আক্রমণ ইত্যাদি বিষয় সুন্দরবনের বিভিন্ন প্রজাতির প্রাচুর্য ও বিস্তারে কী ধরনের অভিঘাত সৃষ্টি করছে সেই অধ্যয়ন কারা কিভাবে করবেন? বাস্তবতা হচ্ছে, সুন্দরবনের ৮০ শতাংশ প্রজাতি সম্পর্কে আমাদের কোনো ধারণাই নেই। হাতে গোনা মাত্র কয়েকটি বিভাময় (ক্যারিজমেটিক) প্রাণী ও উদ্ভিদ নিয়ে সেখানকার জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণসংক্রান্ত প্রায় সব কাজের পরিকল্পনা করা হয়।

একটি পরিবারের কল্যাণ পরিকল্পনায় যেমন সেই পরিবারটির বেশির ভাগ সদস্যের বৈশিষ্ট্য জানার প্রয়োজন হয়, তেমনি যেকোনো বাস্তুতন্ত্র সংরক্ষণ পরিকল্পনায় তার জীব প্রজাতির কমপক্ষে শ্রেণিবিন্যাসের ফ্যামিলি/অর্ডার ধাপ পর্যন্ত জানার দরকার পড়ে। সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ চরিত্র বজায় রাখার জন্য সেখানকার জীব-উপাদানের মধ্যে কর্ডাটা, আর্থ্রোপোডা, মলাস্কা, অ্যানেলিডা ইত্যাদিসহ অণুজীবজগৎ ও তাদের সঙ্গে সেখানকার জড় উপাদান, বিশেষ করে মাটি, পানি ও অন্যান্য ভৌত উপাদান সম্পর্কে বিস্তারিত জ্ঞান থাকা জরুরি। প্রকৃতপক্ষে সুন্দরবনের বাস্তুতন্ত্রকে হুমকি থেকে রক্ষা করতে হলে এর জীব ও জড় উপাদানকে সামগ্রিক বিবেচনায় নিয়ে নিয়মিত পর্যবেক্ষণ, অধ্যয়ন এবং সেই মোতাবেক ব্যবস্থা গ্রহণ করা আবশ্যক। সংগত কারণেই সুন্দরবন ব্যবস্থাপনায় যুগোপযোগী অর্গানোগ্রাম তৈরি ও বাস্তবায়ন এবং তার অভ্যন্তরে নিবিড় গবেষণা নির্বাহ করা প্রয়োজন। সুন্দরবন সংরক্ষণ বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টির জন্য প্রায় দুই দশক আগে প্রস্তাবিত, প্রতিবছর ১৪ ফেব্রুয়ারিকে সরকারিভাবে সুন্দরবন দিবস হিসেবে পালনের জন্য ঘোষণা দেওয়া যেতে পারে।


লেখক : অধ্যাপক (এলপিআর)

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

Post a Comment

0 Comments