বিশ্বের সবচেয়ে বড় অর্থনীতির দুটি দেশ চীন ও যুক্তরাষ্ট্র একে অপরের সঙ্গে পুরোদস্তুর বাণিজ্যযুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এখন এই যুদ্ধে পরিখা থেকে চোরাগোপ্তা হামলা চালানোর কৌশল বাদ দিয়ে সরাসরি সাঁড়াশি অভিযান চালানোর কৌশল বেছে নিয়েছেন।
অনেকের আশঙ্কা, এই বাণিজ্যযুদ্ধ দীর্ঘকাল ধরে চলবে। এখন যা হচ্ছে, তা সূচনামাত্র। আর এটি শুধু বাণিজ্যযুদ্ধে আটকে থাকবে না—এটি শেষ পর্যন্ত সামরিক সংঘাতে রূপ নিতে পারে বলেও আশঙ্কা করছেন অনেকে।
২০০১ সালে চীন বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থায় (ডব্লিউটিও) যোগ দেওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র চীনের অর্থনীতির ওপর সতর্ক দৃষ্টি রাখছে এবং চীনা মুদ্রা রেনমিনবিকে অবমূল্যায়ন করে আসছে। কিন্তু গত ১০ বছরে ডলারের বিপরীতে চীনা মুদ্রা শক্তিশালী হয়েছে। এখন যুক্তরাষ্ট্র চীনের মেধাসম্পদ সংরক্ষণব্যবস্থার দুর্বলতাগুলোর দিকে দৃষ্টি দিয়েছে। চীন বিদেশি প্রযুক্তি নকল করছে কি না, তা–ও নজরদারি করছে তারা।
এসব বিবেচনায় বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, আমেরিকান আধিপত্যের সামনে সবচেয়ে বড় হুমকি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে চীন।
তবে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি হলো চীনের মানুষের মধ্যে নতুন করে জাতীয়তাবাদী চেতনার উত্থান। নতুন প্রজন্মের এই জাতীয়তাবাদীদের ‘নতুন বামপন্থী’ বলে আখ্যায়িত করা হচ্ছে। তারা পশ্চিমাবিরোধী। তারা নতুন ধরনের ধনতন্ত্রে চীনকে সজ্জিত করে তাকে অপ্রতিরোধ্য করে তুলতে চায়।
ট্রাম্প যে বাণিজ্যযুদ্ধের ঘোষণা দিয়েছেন, তার জবাবে চীন ইতিমধ্যেই পাল্টা ব্যবস্থা নেওয়া শুরু করে দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের পণ্য আমদানিতে চীন কর বাড়িয়েছে। একই সঙ্গে অন্য দেশের ক্ষেত্রে করের পরিমাণ কমিয়েছে।
অন্য দেশের উদ্যোক্তারা যাতে চীনে বিনিয়োগ করতে উৎসাহিত হন, সে জন্য নানা ধরনের সুবিধা তৈরি করে দিচ্ছে তারা। ব্যাংকিং, ইনস্যুরেন্স, নিরাপত্তা ইত্যাদি খাতে বিদেশিদের বিনিয়োগের সুযোগ খুলে দেওয়া হয়েছে।
সি চিন পিং মনে করেন, ‘দেরি করার চেয়ে তাড়াতাড়ি করা ভালো; ধীরে যাওয়ার চেয়ে দ্রুত যাওয়া ভালো।’ চীনের সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক তৎপরতা এই নীতিতে এগোচ্ছে বলে মনে করা হচ্ছে। দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংক এ বছর ১১টি কার্যক্রম চালুর ঘোষণা দিয়েছিল। গত এপ্রিলেই তারা এর মধ্যে কমপক্ষে সাতটি প্রকল্প সম্পাদন করে ফেলেছে।
চীন বরাবরই রপ্তানিনির্ভর অর্থনীতির ওপর চলে। কিন্তু এখন সরকার দেশি পণ্য ব্যবহারে দেশের মানুষকে উৎসাহিত করছে। এ লক্ষ্যে তারা পণ্যে নতুন নতুন সৃজনশীলতা যোগ করছে। বহু কোম্পানি তাদের উৎপাদনক্ষমতা ও সৃজনশীলতা বাড়াতে দ্বিগুণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্র যেহেতু চীনকে শাস্তি দেবে বলে মাঠে নেমেছে, সেহেতু চীন নিজেকে রক্ষার জন্য নিজের চারপাশে দুর্গ গড়ার কাজে নেমেছে। এর জন্য তার সামনে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ এসেছে। এটি তাকে এখন মোকাবিলা করতে হবে। এটি নিশ্চিত করেই বলা যায়, ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’ নামে চীন যে পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে, তা বাস্তবায়ন করা কঠিন।
অনেক সময় বাণিজ্যযুদ্ধে জয়লাভ করা পক্ষের চেয়ে পরাজিত পক্ষ আখেরে লাভবান হয় বেশি। ১৯৮০–এর দশকে প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যান জাপানের বেশ কয়েকটি ব্র্যান্ডের গাড়ি আমদানির ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করেন। এ সিদ্ধান্তের কারণে জাপান গাড়ি রপ্তানি করতে না পেরে বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
রিগ্যানের বিধিনিষেধ এড়িয়ে জাপান যাতে যুক্তরাষ্ট্রে আবার গাড়ি রপ্তানি করতে পারে, সে জন্য তারা গাড়ির মান অনেক উন্নত করে ফেলে। এর মধ্য দিয়ে তাদের গাড়ির গড়পড়তা মান অনেক ওপরে উঠে আসে।
ট্রাম্প মনে করছেন, বাণিজ্যের মাধ্যমে চীনকে আক্রমণ করতে পারলে তাঁর ‘মেক আমেরিকা গ্রেট অ্যাগেইন’ স্লোগান আরও জোরালো হবে। কিন্তু তিনি হয়তো এটি খেয়াল করছেন না, এতে চীন আগের চেয়ে বেশি শক্তিশালী হবে।
0 Comments