সর্বশেষ

6/recent/ticker-posts

Header Ads Widget

 দিল্লির চিঠি

বাংলাদেশ ও ভারতের পরস্পরকে আরো বেশি প্রয়োজন

জয়ন্ত ঘোষাল

২০ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩

kalerkantho

দুই ঘনিষ্ঠ বন্ধুর সম্পর্ক যতই সুদৃঢ় হোক, যতই গভীর হোক, সেই বন্ধুত্বকে আজকের এই দুনিয়ায় নানা ধরনের প্রতিকূলতার আবহে সজীব রাখা, অটুট রাখা খুব সহজ কাজ নয়। আর সেই কাজটি করতে প্রয়োজন দুই বন্ধুর মধ্যে ঘন ঘন সাক্ষাৎ। পারস্পরিক বোঝাপড়া। প্রতিশ্রুতি এবং প্রতিশ্রুতি পালনের দায়বদ্ধতা। সারাক্ষণ দুই পক্ষের এই বন্ধুত্বের সামগ্রিক চুক্তির বাস্তবায়নের মূল্যায়ন। কূটনীতিতে একে বলা হয় এনগেজমেন্ট। এ এক বিশেষ ধরনের কূটনৈতিক জনসম্পর্ক। ভারত সেই কাজটা করতে বদ্ধপরিকর। বাংলাদেশ সব চাপান-উতোর, অভাব-অভিযোগ সামনে রেখেও আলোচনার মাধ্যমে তা সব সময় নিষ্পত্তির দর্শনে বিশ্বাসী।



আর এই ভারত-বাংলাদেশ বন্ধুত্বের কূটনীতির সাম্প্রতিকতম নিদর্শন ভারতের পররাষ্ট্রসচিব বিনয় মোহন কাত্রার  (Vinay Mohan Kwatra) ঢাকা সফর। এই ঢাকা সফরে গিয়ে বিনয় কাত্রা গণভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠক করেন। সেই সৌজন্য সাক্ষাতে তিনি শেখ হাসিনাকে বলেছেন, ‘আপনার এবং আপনার নেতৃত্বের প্রতি আমাদের পূর্ণ সমর্থন রয়েছে।’ দুই পররাষ্ট্রসচিব বাংলাদেশের মাসুদ বিন মোমেন আর বিনয় কাত্রা—ফরেন অফিস কথোপকথনের প্রক্রিয়াকে আরেকবার পুনরুজ্জীবিত করেছেন। যাকে বলা হয় এফওসি, ফরেন অফিস কনসালটেশন। এই আলোচনার মাধ্যমে ভারতে হতে চলা জি২০ সম্মেলনে শেখ হাসিনাকে বিশেষভাবে আনুষ্ঠানিক আমন্ত্রণ জানিয়েছে ভারত। আর যেসব প্রকল্প নিয়ে ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে কিছু দূরত্ব তৈরি হয়েছে, সেগুলো ঘোচানোর চেষ্টা হয়েছে। যেমন—২০২২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে শেখ হাসিনা যখন ভারতে আসেন এবং কুশিয়ারা ও আরো কিছু নদীর পানিবণ্টন নিয়ে ভারতের সঙ্গে চুক্তি হয়। সেগুলোর বাস্তবায়ন কিভাবে হচ্ছে, কবে হবে, তার পথনির্দেশিকা, সেসবও কিন্তু চূড়ান্ত হয়েছে এই বৈঠকে। আন্তঃসীমান্ত নদীর পানিবণ্টন এ এক মস্ত বড় সমস্যা। এক দিনে তার সমাধান হয় না। কিন্তু দুই দেশই তার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এমনকি তিস্তা চুক্তিরও বাস্তবায়ন কিভাবে সম্ভব, সেটা নিয়েও কিন্তু আলাপ-আলোচনার পথ বন্ধ হয়ে যায়নি।

বাংলাদেশের মিডিয়ার কাছে একটা জিজ্ঞাসা ছিলই, আদানির বিদ্যুত্ প্রকল্পের ভবিষ্যত্ কী হবে, আদানির বর্তমান পরিস্থিতি বাংলাদেশকে কোনোভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করবে কি না। কিন্তু বাংলাদেশের পররাষ্ট্রসচিবও বলেছেন যে আদানি নিয়ে কোনো সুনির্দিষ্ট আলোচনা হয়নি। কেননা আলোচনার বিষয়বস্তুর মধ্যে তো আদানির বিদ্যুত্ প্রকল্প ছিল না। কিন্তু সামগ্রিকভাবে বিদ্যুত্ বণ্টনে ভারত-বাংলাদেশের বোঝাপড়া এবং পাইপলাইন কিভাবে হবে এবং বিদ্যুত্ জোগানের ব্যাপারে ভারতের যে দায়বদ্ধতা, সেসব নিয়েও কিন্তু সবিস্তার আলোচনা হয়েছে।

দুই দেশের পররাষ্ট্রসচিবের বৈঠকের পর বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে একটি বিবৃতি প্রদান করা হয়েছে, যাতে কী কী বিষয় আলোচনা হয়েছে তার সবিস্তার বিবরণ দেওয়া হয়েছে। সেখান থেকে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য বিষয়, যেমন—বিদ্যুত্ ক্ষেত্রে ভারতের দায়বদ্ধতা, সীমান্ত সন্ত্রাস অনেকটা কমে যাওয়ায় ভারত এবং বাংলাদেশ দুই পক্ষেরই সন্তোষ প্রকাশ এবং দুই পক্ষই বলছে যে একেবারেই সীমান্ত সন্ত্রাসকে শূন্য জায়গায় নিয়ে আসতে হবে। কেননা বাংলাদেশের পক্ষ থেকেও বারবার অভিযোগ করা হয়েছে যে সীমান্তে সন্ত্রাস করার পেছনে ভারতের আধাসামরিক বাহিনীরও কিছু ভূমিকা থাকে, যা পরিস্থিতিকে আরো জটিল করে। এ কারণে বাংলাদেশ রাইফেলস আর বিএসএফের মধ্যেও বেশ কয়েক দফা বৈঠক হয়েছে এবং পরিস্থিতিকে নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা হয়েছে। আবার ভারতের পক্ষ থেকেও অভিযোগ করা হয়, চোরাকারবারি এবং অনুপ্রবেশ বন্ধ করার জন্য এ ধরনের আক্রমণাত্মক ব্যবস্থা অনেক সময় আধাসামরিক বাহিনীকে নিতে হয়। এ এক দীর্ঘদিনের বিতর্ক, কিন্তু সব কিছুই আলোচনার মাধ্যমে নিষ্পত্তি সম্ভব। এই বিবৃতিতে দেখা যাচ্ছে, সেই ইতিবাচক দিকটি ফুটে উঠেছে।

এই বিবৃতিতে বলা হয়েছে—

১. ভারত আমাদের নিকটতম প্রতিবেশী রাষ্ট্র এবং খুবই গুরুত্বপূর্ণ বন্ধু রাষ্ট্রও বটে। ভারতের সঙ্গে আমাদের যে সম্পর্ক, তা ঐতিহাসিক। কারণ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের সহায়তা এবং স্বাধীনতা-পরবর্তীকালেও বিভিন্নভাবে সহযোগিতা দুই দেশের এই বন্ধুত্বকে বিশেষ মাত্রা দিয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার এই বৃহত্তম দেশ ভারত আজ অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত ক্ষেত্রে প্রভূত সাফল্য অর্জন করেছে।


২. দুই দেশের মধ্যে থাকা সব অমীমাংসিত বিষয় আশু নিষ্পত্তির জন্য বাংলাদেশের সবচেয়ে নিকটবর্তী ও গুরুত্বপূর্ণ বন্ধু দেশ ভারতের কাছে সহযোগিতা কামনা করি। আর তার জন্য আমরা একযোগে কাজ করার ব্যাপারে গুরুত্ব দিই। এ ছাড়া তিস্তাসহ অন্যান্য সব আন্তঃসীমান্ত নদীর পানিবণ্টনের বিষয়ে দ্রুত চুক্তি সম্পাদনের ব্যাপারে গুরুত্ব আরোপ করি। আর এ বিষয়টির সমাধানের জন্য ভারতের আন্তরিক সহযোগিতা প্রত্যাশা করেছি।

৩. বর্তমানে সীমান্ত হত্যা উল্লেখযোগ্য হারে হ্রাস পেয়েছে। তবে আমরা এটিকে শূন্যে নামিয়ে আনতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। এই লক্ষ্যে ভারত সরকার উদ্যোগ গ্রহণ করবে বলে দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেছে। তা ছাড়া আন্তঃসীমান্ত অপরাধ, মাদকপাচারসহ অন্যান্য অপরাধমূলক কার্যক্রম নির্মূলে আমাদের চলমান প্রচেষ্টা জোরদার করতে সম্মত হয়েছি।

৪. এ ছাড়া বিবৃতিতে আরো বলা হয়েছে, ভারত আমাদের দ্বিতীয় বৃহত্তম বাণিজ্যিক অংশীদার। ভারতের সঙ্গে আমাদের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য বৃদ্ধির জন্য বিদ্যমান ট্যারিফ, প্যারাট্যারিফের মতো বাধাগুলো দূর করার ওপর আমরা গুরুত্ব আরোপ করেছি। আমরা ভারত থেকে আমাদের নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণের জন্য অনুরোধ করেছি। ভারতের সঙ্গে আমাদের দ্বিপক্ষীয় এবং আঞ্চলিক পর্যায়ে রেল ও সড়ক যোগাযোগ বৃদ্ধি করতে আমাদের চলমান প্রচেষ্টা এবং কার্যক্রম বেগবান করতে আমরা একমত হয়েছি।

৫. বর্তমানে ভারতের সঙ্গে জ্বালানি এবং বিদ্যুত্ খাতে আমাদের পারস্পরিক সহযোগিতা ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমরা ভারত থেকে বর্তমানে প্রায় এক হাজার ১৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুত্ আমদানি করছি। ভারত থেকে আমাদের বিদ্যুত্ আমদানি আগামী দিনে উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পাবে মর্মে আশা করছি। চলমান ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এই সহযোগিতা বৃদ্ধি এবং বিশেষ করে বাংলাদেশে প্রয়োজনীয় জ্বালানি সরবরাহের ওপর আমি গুরুত্ব আরোপ করেছি। ভারত থেকে জ্বালানি আমদানি করতে বাংলাদেশ এবং ভারতের যৌথ উদ্যোগে নির্মিত  ‘India-Bangladesh Friendship Pipeline’-এর উদ্বোধনের বিষয়ে আলোচনা করেছি। ভারতের মধ্য দিয়ে নেপাল ও ভুটান থেকে বিদ্যুত্ আনার বিষয়েও আমি ভারতের সহযোগিতা কামনা করেছি।

৬. বাংলাদেশের এই অঞ্চলের শান্তি ও স্থিতিশীলতা রক্ষায় এবং রোহিঙ্গা সংকটের স্থায়ী সমাধানে বাংলাদেশে অবস্থানরত ১.১ মিলিয়ন রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের ক্ষেত্রে ভারতের দ্রুত ও সক্রিয় পদক্ষেপ গ্রহণের ব্যাপারে আহ্বান জানিয়েছি। এ ছাড়া প্রতিবছর পর্যটন এবং চিকিত্সা উপলক্ষে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বাংলাদেশি ভারত সফর করে। তাদের ভিসা প্রাপ্তি সহজীকরণসহ অন্যান্য  Consular issue সহজীকরণের জন্য আমরা অনুরোধ জানিয়েছি।

৭. ভারতের পররাষ্ট্রসচিব বিনয় মোহন কাত্রা  (Vinay Mohan Kwatra) মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রসহ সব ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অভূতপূর্ব উন্নয়নের ভূয়সী প্রশংসা করেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রীর আমন্ত্রণে জি২০-এর ‘Voice of the South Summit 2023’ শীর্ষক সম্মেলনে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর অংশগ্রহণ এবং উন্নয়নের অগ্রগতিতে বাংলাদেশ একটি রোল মডেল হিসেবে তাঁর অভিজ্ঞতা তুলে ধরার জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর প্রতি তিনি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। তিনি বলেছেন, বাংলাদেশ ভারতের  ‘Neighborhood First’  নীতির আওতায় সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার লাভ করে। তিনি বলেছেন, বাংলাদেশ ভারতের বিশ্বস্ত বন্ধু। তাই সব বিষয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে একসঙ্গে কাজ করার বিষয়ে তিনি ভারত সরকারের গভীর আগ্রহ এবং প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেন।


৮. ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সব দ্বিপক্ষীয় বিষয়, যেমন—পানিবণ্টন, সীমান্ত ব্যবস্থাপনা, বাণিজ্য, কানেক্টিভিটি, দুই দেশের জনগণের মধ্যে যোগাযোগ, বিদ্যুত্, জ্বালানিসহ সব ইস্যুতে ভারতের সহযোগিতা বৃদ্ধির বিষয়ে ভারত সরকারের চলমান প্রচেষ্টা জোরদার করা হবে—এই মর্মে তিনি উল্লেখ করেন এবং একসঙ্গে কাজ করার বিষয়ে ঐকমত্য প্রকাশ করেন।

আজকের সময়টা খুব জটিল। একটা ত্রস্তবিধ্বস্ত সময়, যখন চীনের ড্রাগনের নিঃশ্বাস এসে পড়ছে ভারতের হিমালয়ের পাদদেশে। আবার অরুণাচলের সীমান্ত বেশ উত্তেজনাপূর্ণ হয়ে রয়েছে। ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক তলানিতে এসে ঠেকেছে। বিভিন্ন প্রতিবেশী রাষ্ট্রে চীনের প্রভাব-প্রতিপত্তি বাড়ছে বলে ভারত উদ্বিগ্ন, অন্যদিকে আমেরিকার সঙ্গে চীনের সঙ্গে সংঘাত বাড়ছে বৈ কমছে না। ইউক্রেনের সঙ্গে রাশিয়ার যুদ্ধ থামার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। সব মিলিয়ে আর্থিক সমস্যাও পৃথিবীজুড়ে চরমে। তারই মধ্যে বাংলাদেশকে একটা উন্নয়নের মডেল ঘোষণা করে ভারত কিন্তু জি২০ সম্মেলনে বিশেষ মর্যাদা দিয়েছে বাংলাদেশকে। এই প্রতিকূল পরিস্থিতিতে বাংলাদেশকেও পাশে বিশেষভাবে ভারতের প্রয়োজন। বাংলাদেশেরও ভারতের সঙ্গে থেকে এই উপমহাদেশের আর্থিক এবং সামাজিক অগ্রগতিতে এগিয়ে যাওয়া প্রয়োজন। সেই কারণেই জি২০ সম্মেলনের আগে দুই পররাষ্ট্রসচিবের বৈঠক বিশেষ তাত্পর্যপূর্ণ।


 


 লেখক : নয়াদিল্লিতে কালের কণ্ঠ’র


বিশেষ প্রতিনিধি

Post a Comment

0 Comments