উদ্যোক্তা হওয়ার সুযোগ আছে
এ কে এম আতিকুর রহমান
৫ জুন, ২০২১
তথ্যসূত্র: কালের কণ্ঠ
কয়েক সপ্তাহ আগে বাংলাদেশের একটি টেলিভিশন চ্যানেলে নবাগতদের ব্যবসা শুরু করার বিভিন্ন দিক সম্পর্কে একটি আলোচনা শুনছিলাম। একজন শিক্ষার্থী, যে একজন ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার স্বপ্ন দেখত, সেই ক্ষেত্রে ব্যর্থ হয়ে সে যখন সাদামাটা স্নাতক ডিগ্রি নিয়ে একটি চাকরিও জোগাড় করতে পারেনি, তখন সে স্বভাবতই তার ভবিষ্যতের গন্তব্য সম্পর্কে হতাশ হয়ে পড়ে। সে একটি কাজের আশায় এক অফিস থেকে আরেক অফিসে কতই না দৌড়ঝাঁপ করল। একসময় তার বয়স চাকরির জন্য আবেদন করার সীমাও অতিক্রম করে যায়। তার মা-বাবা, পরিবারের সদস্য বা বন্ধুরা, যাঁরা কয়েক বছর আগে তার উজ্জ্বল ভবিষ্যতের বিষয়ে অনেক প্রশংসা করেছিলেন, তাঁরাও তাকে নিয়ে চিন্তা-ভাবনা ছেড়ে দেন। অবশেষে ওই যুবকটি কাজের অন্য কোনো সহজ পথ খুঁজে না পেয়ে ব্যবসা শুরু করার চিন্তা করে। কিন্তু ব্যবসা পরিচালনার জন্য তার যেমন কোনো অভিজ্ঞতা ছিল না, তেমনি তার কাছে ছিল না কোনো টাকা-পয়সা। যাই হোক, তার একটি অভিনব ধারণা ছিল যা তাকে ব্যবসা শুরু করার আলো দেখায়। এটি ছিল ব্যবসার ক্ষেত্রে একটি উদ্ভাবন, একটি নতুন পণ্য, যা সে বাংলাদেশে প্রথম প্রবর্তন করে। এটি স্থানীয় বাজারে সহজেই প্রবেশ করতে সমর্থ হয়। বর্তমানে তার সংস্থায় এক হাজারেরও বেশি কর্মী কাজ করছে। আসলে তার বিনিয়োগটি ছিল তার নতুন ধারণা, তার উদ্ভাবন, অর্থ নয়।
এটি একটি উৎসাহব্যঞ্জক আলোচনা ছিল এবং আমাদের কর্মসন্ধানী শিক্ষিত তরুণরা যদি ওই আলোচনাটি শুনে থাকে, তবে তা তাদের নতুন কিছু ভাবতে অনুপ্রাণিত করবে। আমি ওই আলোচনাটি থেকে যতটুকু বুঝতে পেরেছি তা হলো, ব্যবসা করার জন্য আগ্রহী একজনের থাকতে হবে—ক. দৃঢ় সংকল্প, খ. উদ্দীপনা, গ. উদ্ভাবনী শক্তি এবং ঘ. অসীম সাহস। অবশ্যই যাদের কাছে অনন্য বা নতুন পণ্য তৈরির ধারণা রয়েছে, যার স্থানীয় বা আন্তর্জাতিক বাজারে ভালো চাহিদা বিদ্যমান, তাদের পক্ষে ব্যবসা শুরু করা অনেকটাই সহজ হয়ে দাঁড়াবে। প্রাথমিক পর্যায়ে এ কাজটি শুরু করা ঝুঁকিপূর্ণ বলে মনে হতে পারে। তবে যদি কেউ সংকল্পবদ্ধ হয় এবং তার মধ্যে প্রবল উদ্দীপনা ও অসীম সাহস থাকে, তার পক্ষে সব বাধা অতিক্রম করে একটি সম্ভাবনাময় জীবনের দিকে এগিয়ে যাওয়া মোটেই কঠিন নয়।
বাংলাদেশের সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে প্রতিবছর হাজার হাজার তরুণ বিভিন্ন বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করে। সাধারণত তাদের বেশির ভাগই সরকারি অফিসে বা বেসরকারি সংস্থায় চাকরির জন্য হন্যে হয়ে ঘুরতে থাকে। তাদের বেশির ভাগই চাকরি নামক সোনার হরিণটি ধরতে ব্যর্থ হয় এবং শেষ পর্যন্ত হতাশায় জর্জরিত হয়ে পড়ে। তারা ভুলে যায় যে জীবন এত ছোট পরিমণ্ডলে সীমাবদ্ধ নয়। চাকরি করাই শিক্ষার একমাত্র লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য নয়। এর বাইরেও বিস্তৃত আলোকোজ্জ্বল সবুজ পৃথিবী রয়েছে। তাদের উচিত নিজ নিজ মেধা, দক্ষতা এবং চিন্তা-ভাবনা প্রয়োগের মাধ্যমে সেই বিস্তীর্ণ এলাকার ফটকটি খুলে ফেলা। তবে এ ক্ষেত্রে তাদের থাকতে হবে উদ্ভাবনী শক্তি ও স্বতঃস্ফূর্ত উদ্দীপনা এবং হতে হবে আন্তরিক, সাহসী ও সংকল্পবদ্ধ।
kalerkanthoউদ্ভাবন প্রসঙ্গে ভূতাত্ত্বিক যোগাযোগ উপগ্রহের উদ্ভাবক স্যার আর্থার সি ক্লার্ক বলেছেন, ‘প্রথম দিকে লোকেরা আপনাকে বলবে যে এটি একটি অত্যুৎসাহী ধারণা এবং এটি কখনোই কার্যকর হওয়ার নয়। এরপর লোকেরা বলবে যে আপনার ধারণাটি কার্যকর হতে পারে, তবে এটি তেমন একটা অর্থবহ হবে না। পরিশেষে লোকেরা বলবে, আমি আপনাকে বলেছিলাম যে শুরু থেকেই এটি ছিল একটি অসাধারণ ধারণা।’
আমাদের সমাজেও এই মনমানসিকতার মানুষের অভাব নেই। আপনি যদি নতুন কিছু নিয়ে ভাবেন বা করেন, আপনার চারপাশের লোকেরা স্বল্প সময়ের মধ্যেই বিজ্ঞজনের মতো প্রচুর মন্তব্য করে ফেলবে এবং ওই শব্দগুলো কখনোই উৎসাহজনক নয়। তারা আপনার নতুন ধারণা বা সক্ষমতাকে খুব ছোট করে দেখবে। তবে আপনার ধারণাটিকে প্রকাশ বা বাস্তবে রূপ দেওয়ার জন্য আপনাকে হতে হবে সংকল্পবদ্ধ ও নিবেদিত। আপনি একবার আপনার গন্তব্যে পৌঁছে গেলে সেই ব্যক্তিরাই এবার আপনার প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে অন্য কিছু বলতে আপনার কাছে ছুটে আসবে।
আমি বিশ্বাস করি, উদ্ভাবনের বা নতুন কিছু করার কাজটি অবশ্যই অতটা সহজ নয়। তবে আপনি যদি সত্যিই আপনার ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন ঘটাতে চান, আপনাকে নিঃসন্দেহে নতুন কিছু আনতে হবে। অন্যথায় আপনি যে জায়গায় হতাশায় নিমজ্জিত হয়ে বসে আছেন সেখানেই রয়ে যাবেন। আলো এবং অন্ধকারের মধ্যকার পার্থক্যটি আপনাকে বুঝতে হবে। আপনাকে প্রমাণ করতে হবে যে আপনার বেঁচে থাকার যোগ্যতা রয়েছে। দৃঢ়ভাবে দাঁড়ানোর জন্য আপনাকে শক্তি অর্জন করতে হবে। হ্যাঁ, এই সাফল্য অর্জনের জন্য আপনাকে অবশ্যই ঝুঁকি নিতে হবে।
পিটার এইচ ডায়ামন্ডিস এবং স্টিভেন কোটলার তাঁদের ‘অ্যাবানডনস’ বইয়ের এক জায়গায় লিখেছেন, “দুর্দান্ত ধারণাগুলো প্রদর্শনের ক্ষেত্রে যথেষ্ট পরিমাণে ঝুঁকি জড়িত। সেখানে সর্বদাই থাকবে ‘না’ বলার লোকজন। লোকজন সাফল্যজনক ধারণাকে প্রতিহত করে যাবে যতক্ষণ না তারা তা নতুন মান হিসেবে গ্রহণ করবে। যেহেতু প্রাচুর্যের সড়কে উল্লেখযোগ্য উদ্ভাবন প্রয়োজন, তাই ঝুঁকির জন্য, ব্যর্থতার জন্য এবং নিরঙ্কুশ আজেবাজে হিসাবে সবচেয়ে বেশি মনে হওয়া ধারণাগুলোর জন্য যথেষ্ট সহনশীলতা থাকা প্রয়োজন।” একইভাবে, বার্ট রুটান বলেছেন, ‘বিপ্লবী ধারণাগুলো আসে আজেবাজে চিন্তা-ভাবনা থেকে। যদি কোনো ধারণা সত্যিই সাফল্যজনক হয়, তবে এটি আবিষ্কারের আগে অবশ্যই এটি পাগলামি বা আজেবাজে বা উভয় হিসেবে বিবেচিত হবে—তা না হলে এটি সাফল্যজনক কিছু হবে না।’
চলার পথে ব্যর্থতা থাকবে না, হোঁচট খাবে না, এমন নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারে না। এমনকি কখনো এমনটি ঘটে যে আপনি এরই মধ্যে নির্ধারিত লক্ষ্য অনুযায়ী নতুন কিছু খুঁজে পেতে ব্যস্ত রয়েছেন, দুর্ভাগ্যক্রমে এটি ব্যর্থ হয়। তবে এমন অজানা কিছু জিনিসের উদ্ভব ঘটল, যা আপনি প্রত্যাশা করেননি। আশ্চর্যের বিষয়, ওই অন্য জিনিসটাই আপনার উদ্ভাবন হয়ে দাঁড়াল। নিঃসন্দেহে এটি শুধু আপনার জীবনকেই পরিবর্তন করবে না, এটি অন্যদের আপনার সঙ্গে কাজ করার বা সেই প্রচেষ্টা থেকে অন্য ধরনের সুযোগের দ্বার উন্মুক্ত করবে। যদি এ রকম পরিস্থিতি দেখা দেয়, তবে হতাশ না হয়ে বরং আরো ভালো কিছু হওয়ার আশীর্বাদ হিসেবে নিজের প্রচেষ্টাকে অব্যাহত রাখা উচিত। এক নিবন্ধে অধ্যাপক বাবা শিব ব্যাখ্যা করেছিলেন, ‘ব্যর্থতা বেশির ভাগ ব্যবসায়ীর কাছে একটি ভয়ংকর ধারণা। তবে ব্যর্থতা প্রকৃতপক্ষেই নতুনত্বের বিশাল এক চালিকা হতে পারে। কৌশলকে সঠিক দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে নিয়ে যাওয়া এবং আশীর্বাদ হিসেবে ব্যবহার করতে হবে, অভিশাপ হিসেবে নয়।’
পিটার এইচ ডায়মন্ডিস এবং স্টিভেন কোটলার চারটি প্রধান প্রণোদনকে চিহ্নিত করেছেন, যা উদ্ভাবনকে চালিত করে। সেগুলো হলো—ঔত্সুক্য, শঙ্কা, লোভ এবং তাৎপর্য। এটা স্পষ্ট যে ঔত্সুক্য বা কৌতূহল সর্বাধিক ভূমিকা পালন করে, যা প্রকৃতপক্ষে প্রক্রিয়াটিকে শুরু করে থাকে। এটি একটি ইচ্ছা, যা বের করবে কেন ‘ব্ল্যাক বক্স’ খুলতে হবে বা পরবর্তী বাঁকের আশপাশে দেখতে হবে। ঔত্সুক্য বা কৌতূহল নতুন বিষয়ের জন্য আমাদের চিন্তাকে উদ্দীপিত করে, এটিই উদ্ভাবন। এ ক্ষেত্রে শঙ্কা রয়েছে। কারণ এটি ঝুঁকি গ্রহণের সঙ্গে সম্পৃক্ত। যেকোনো উদ্ভাবনের ক্ষেত্রেই ঝুঁকিকে উপেক্ষা করা যায় না। তৃতীয় প্রণোদন হচ্ছে লোভ। লোভ বলতে এখানে সম্পদ তৈরির আকাঙ্ক্ষাকে বোঝায় এবং সংগত কারণেই এই ধারণা প্রতিটি উদ্ভাবনের ক্ষেত্রেই কাজ করে থাকে। চূডান্ত প্রণোদন হচ্ছে তাৎপর্যের প্রতি আকাঙ্ক্ষা, যা প্রকৃতপক্ষে একটি ভিন্ন কিছু তৈরি করার জন্য প্রয়োজন।
হেনরি ফোর্ড বলেছিলেন, ‘সব সময় সামনের চিন্তা, সব সময় আরো কিছু করার চেষ্টার চিন্তা-ভাবনা, যা মনকে এমন একটি অবস্থায় নিয়ে আসে যেখানে কোনো কিছুই অসম্ভব নয়।’ আমাদের শিক্ষিত যুবকরা চাকরির জন্য এত ঘোরাঘুরি না করে তাদের উদ্ভাবনী ধারণা ও সক্ষমতা বিনিয়োগ করবে এবং তাদের নিজস্ব সংস্থা তৈরি করবে, যেখানে তারা অন্যদেরও কাজের সংস্থান দিতে সক্ষম হবে। উদ্যমী যুবকদের মধ্যে ১০ থেকে ২০ শতাংশও যদি উদ্ভাবনী উদ্যোগের সঙ্গে নিজেদের সম্পৃক্ত করতে পারে, তবে আমরা এই দেশে বেকারত্বের বিশাল হ্রাস আশা করতে পারি। আমাদের মনে রাখতে হবে, এই পৃথিবীতে অসম্ভব বলে কিছু নেই।
বলা হয়ে থাকে যে উদ্ভাবনী ধারণা হাতের নাগালেই রয়েছে। এ জন্য চারদিকে তাকাতে হবে। যখনই কোনো সাফল্যজনক ধারণা মনে আসবে, তাকে ধরতে হবে। বিস্তৃত বিশ্বে বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় সাফল্যের মানদণ্ডগুলো আপনার নিজের উদ্যোগ বা উদ্ভাবনীর জন্য যথেষ্ট অনুপ্রেরণা জোগাতে পারে। মূল বিষয় হলো ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করা, আপনার পণ্যটির জন্য প্রয়োজনীয় উপাদানগুলো চিহ্নিত করা এবং সেই অনুযায়ী আপনার নিজের পরিকল্পনা গ্রহণ করা। যাই হোক, আপনাকে নতুন পণ্য, পরিষেবা, লাভ ইত্যাদির জন্য ধারণা নিয়ে আসতে হবে, যা করতে আপনি মনস্থির করেছেন।
পরিশেষে আমি আবারও ‘অ্যাবানডনস’ বইয়ের কয়েকটি লাইন উদ্ধৃত করতে চাই—‘সুতরাং আপনি যদি দুর্দান্ত চ্যালেঞ্জগুলো সমাধান করতে, উদ্যোগ গ্রহণ করতে এবং বিশ্বকে পরিবর্তন করতে আগ্রহী হন, তবে আপনাকে প্রস্তুতি নিতে হবে। ব্যায়ামাগারে যান, আপনার নির্ভীক পেশিগুলো তৈরির জন্য কাজ শুরু করুন এবং আগত সমালোচনার বৃষ্টিকে সহ্য করার জন্য আপনার ত্বককে পুরু করুন। সবচেয়ে বড কথা, আপনি না চাইলে বিশ্বকে পরিবর্তনের চেষ্টা করবেন না, যেমন ঊনবিংশ শতাব্দীর আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্ব শ্রী রামকৃষ্ণ বলে গেছেন, ‘যার চুল আগুনে জ্বলছে এমন মানুষ পুকুর খুঁজবেই।’ অবশেষে যেকোনো কিছুর বিশ্বকে বোঝানোর জন্য অবশ্যই উদ্দীপনা এবং উদ্দেশ্য থাকতে হবে—যা অবশ্যই এটিকে পরিবর্তনের প্রথম পদক্ষেপ।
অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই যে উদ্ভাবন আমাদের সমাজের অগ্রগতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আমাদের যুবকদের সৃজনশীল কাজের জন্য, এগিয়ে আসার জন্য সহায়তা করা আমাদের দায়িত্ব, যা শুধু নিজেদের উপার্জনের পথই সৃষ্টি করবে না, আমাদের জাতীয় অর্থনীতিতে অপরিসীম অবদান রাখবে। সম্ভাবনার নতুন বিশ্বকে নির্ভর করে তারা আন্তরিকতার সঙ্গে উদ্ভাবনী পণ্য এবং পরিষেবা বা নতুন সামাজিক উদ্ভাবনের বিকাশ করতে পারে, যা সামাজিক সমস্যাগুলোর সমাধান করবে। আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস, বাংলাদেশের জনগণ, বিশেষত তরুণ প্রজন্ম নিজেদের যথাযথ স্থানে নিয়োগ করার মাধ্যমে এই দায়িত্বটি কাঁধে নিয়ে এগিয়ে যাবে। এবং এটিই হতে পারে একমাত্র বিকল্প উপায়, যার ভিত্তিতে আমাদের যুবকরা তাদের জীবন পরিবর্তনের জন্য নতুন চিন্তা-ভাবনা এবং ধারণার বীজ বপন করবে। আশা করি আমাদের সরকার এসব উদ্ভাবনী কাজে তাদের পাশে দাঁড়াবে এবং প্রয়োজনীয় সহায়তামূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করবে।
লেখক : সাবেক রাষ্ট্রদূত ও সচিব
0 Comments