সর্বশেষ

6/recent/ticker-posts

Header Ads Widget

ছোট ছোট বিনিয়োগের বড় বড় স্বপ্ন

ছোট ছোট বিনিয়োগের বড় বড় স্বপ্ন

খন্দকার হাসনাত করিম  

০২ জুন ২০২১

তথ্যসূত্র: নয়াদিগন্ত


বৈশ্বিক মহামারী কোভিড-১৯ গোটা পৃথিবীর আর্থ-সামাজিক কাঠামোকে বিপর্যস্ত করে ফেলেছে। দেশে দেশে অর্থনীতির ‘নীতি’টুকু পড়ে আছে; ‘অর্থ’ লুপ্ত হতে বসেছে। পেশা ও কর্মের সুযোগ সঙ্কুচিত হতে হতে তলানিতে এসে ঠেকেছে। এমনিতেই বাংলাদেশ পরিবেশগত বিপর্যয়ে বিধ্বস্ত। প্রতি বছর বন্যা, ঝড়, খরা, লবণাক্ততা, পতঙ্গ-বালাই ইত্যাদি মানুষের জীবন ও কৃষিকে বিপর্যস্ত করছে। এর সাথে এখন যুক্ত হয়েছে অদৃশ্য এক দুশমনের হানাদারি। ছোট ছোট ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তারা বহু কষ্টে বহু সাধনায় এখনো তাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছেন। কিন্তু অবস্থা যেদিকে এগোচ্ছে তাতে অস্তিত্ব রক্ষার শেষ চেষ্টা ও সুযোগ হাতছাড়া হওয়া মাত্র সময়ের ব্যাপার। বড় উদ্যোক্তাদের সমস্যা বড়; তবে তাদের সুযোগও বেশি। তাদের সামনে থাকে একাধিক বিকল্প ও একাধিক ঋণ উৎস। সেবা খাতগুলোতেও নেই ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের পাশে দাঁড়ানোর তেমন কোনো কাঠামোগত সুযোগ, সদিচ্ছা বা সুনীতি। ছোট উদ্যোগগুলো এখন বড় সমস্যার জালে আটকা। টিকে থাকাটাই তাদের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ। মহামারীর কারণে ক্ষুদ্র বিনিয়োগ বা ক্ষুদ্রঋণের কাঠামো সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তাদের বিক্রি বন্ধ নতুবা ‘বাকি’র ফাঁদে আটকা। অথচ উৎপাদনের কাঁচামাল কিনতে হয় নগদে এবং তার দামের সাথে মূল্য সংযোজন কর যুক্ত অথবা নগদে প্রদেয়। সেবা প্রতিষ্ঠানগুলোর সাথে গ্রাহকের সম্পর্কও নগদে। সেখানে বিলিং ব্যবস্থা মোটেও মানবিক বা সহানুভূতিশীল নয়। রাষ্ট্রীয় সেবা খাতেরও ব্যবস্থাপনা মূলনীতি বাণিজ্যিক স্বার্থ দ্বারা পরিচালিত। পৃথিবীর কোথাও গ্যাস-পানি-বিদ্যুতের পরিচালনা ব্যবস্থা আমাদের দেশের মতো এত শোষণমূলক নয়।


করোনা মহামারীতে রাষ্ট্রীয় সেবাখাতগুলোর অকার্যকারিতা বা অসহায়ত্বের দায় তাদের নিজেদের উপর খুব কমই বর্তায়; কিন্তু এর ফলে সর্বাংশে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন সাধারণ মানুষ তথা ছোট ছোট উদ্যোক্তা। নীতিনির্ধারকরা তাদের সভা-সমাবেশ ‘ভার্চুয়াল’ভাবে করতে পারলেও উৎপাদন (প্রোডাকশন) নিতান্তই একটি ‘ফিজিক্যাল’ বা কায়িক ব্যাপার। ফলে মহামারীর ঝুঁকি সাধারণ মানুষের ওপরই বহুলাংশে বর্তাচ্ছে। শহরাঞ্চলের চেয়ে গ্রামীণ দারিদ্র্যের অবস্থা আরো শঙ্কাজনক। গ্রামে কাজ নেই। কৃষিতে কর্মসংস্থান বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই মওসুমি। তা ছাড়া মধ্যম ধরনের গৃহস্থরা এখন নিজেরাই সপরিবারে কৃষিকাজে জড়িত। আগে ‘মঙ্গার দেশ’ থেকে বহু দিন-হাজিরার কৃষিকর্মী পাওয়া যেত। এখন এই প্রকট করোনাকালে তারাও গ্রাম ছেড়ে আসে কম; অনেকে কৃষি ছেড়ে অকৃষি বৃত্তি বা অন্য কাজে জড়িত। পৃথিবীর বহু দেশ করোনা মহামারীকালে ক্ষুদ্রঋণের বকেয়া মওকুফ করে দিয়েছে। আমাদের দেশে সে সবের বালাই নেই। কারণ রাষ্ট্র এখানে প্রজাবান্ধব নয় (নাম যদিও প্রজাতন্ত্র!)

ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে আমাদের অনেক কিছু করার আছে। করার চেয়ে বেশি আছে ভাবার। বাজেট হওয়ার আগে বিষয়গুলো নিয়ে যত কার্যকর ও সিদ্ধান্তমুখী আলোচনা হয় ততই মঙ্গল। এবারের বাজেট হচ্ছে করোনা-বিপর্যয় মোকাবেলার বাজেট। অর্থনীতির বিচিত্র ও বিবিধ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে সামষ্টিক অর্থনীতির সূচকগুলোর উন্নয়ন, জিডিপি প্রবৃদ্ধি, কর্মসংস্থান এবং দারিদ্র্য বিমোচনের মাধ্যমে দেশকে করোনা-পূর্ব অবস্থায় ফিরিয়ে নিতে সরকার কতটা আন্তরিক এবং বাস্তবমুখী তারই প্রতিফলন ঘটতে যাচ্ছে আসন্ন বাজেটে। পৃথিবীর-কাঁপানো করোনা পরিস্থিতি আশা করা হয়েছিল, স্বাভাবিক হয়ে আসবে। কিন্তু স্বাভাবিক হওয়া দূরে থাকুক; নিত্যনতুন প্রকরণ (ভ্যারিয়েন্ট) বৃদ্ধির মধ্য দিয়ে করোনা যেন আরো জেঁকে বসছে। করোনার সাথী হয়ে এসেছে নতুন পদের কিছু ছত্রাক (যেমন কালো ও হলুদ ফাঙ্গাস)। নতুন প্রকরণগুলো নাকি আরো বেশি প্রাণঘাতী। করোনা শুধু গণস্বাস্থ্যকেই ঝুঁকিতে ফেলেনি, গোটা অর্থনীতিকেই ঝুঁকিতে ফেলেছে। এবারো বাজেটের একটা তাৎপর্যপূর্ণ অংশ দখল করে নেবে স্বাস্থ্য খাত। কিন্তু তা হলে কী হবে? দেশের সমগ্র স্বাস্থ্যব্যবস্থাই ধসে পড়েছে। এই খাতে ব্যয় বরাদ্দের ৬০ শতাংশই নাকি ব্যয় হয়ে যায় চিকিৎসক-চিকিৎসাকর্মী এবং স্বাস্থ্য প্রশাসনের পেছনে। দেশবাসীর জন্য পড়ে থাকে মাত্র ৪০ শতাংশ। করোনা থাকবে এবং করোনা নিয়েই আমাদের বাঁচতে হবে, এই ধারণা থেকেই বাজেটে স্বাস্থ্য খাতের ওপর ব্যাপক গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। আর একটি বড় বিবেচনার খাত হলো করোনার আরো এক শিকার শিক্ষা খাত। এ নিয়ে বহু মানুষ ও প্রতিষ্ঠান, বিশেষ করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো খোলা নিয়ে দীর্ঘ দিন ধরে আলাপ-আলোচনা করে আসছে। কিন্তু এখনো কোনো সিদ্ধান্তে কেউ পৌঁছতে পারেননি। শিক্ষাবর্ষ অকার্যকর হয়ে থাকলে তার কুফল অনিবার্যভাবেই পড়বে পরবর্তী শিক্ষাবর্ষগুলোর ওপর, ঠিক যেমনটা হয়েছিল সেশনজটের ক্ষেত্রে।

অতিক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প উদ্যোগের সামাজিক গুরুত্ব সব সময়ই ছিল, এখন করোনাকালে এই গুরুত্ব বেড়েছে অনেক বেশি। সাধারণ মানুষ তাদের সীমিত মূলধন, সীমিত যন্ত্রপাতি ও অসীম স্বপ্ন নিয়ে এই খাতেই উদ্যোগ নিয়ে বাঁচার চেষ্টা করে থাকে। তাদের নিকটাত্মীয়-পোষ্য-পরিজনদের বিদেশ থেকে পাঠানো ‘রেমিট্যান্সের’ অর্থ বেশির ভাগই ব্যয় হয় এমএসএমই খাতে বিনিয়োগে। কেননা তাদের সীমিত পুঁজিতে সঞ্চয়ও তেমন জমে না, বড় উদ্যোগের শেয়ার কেনার পথেও বাদ সেধেছে ধ্বংসোণুখ শেয়ারবাজার। করোনা মহামারীর সময় এমএসএমই খাতে নতুন করে ভাবনা চিন্তার তাগিদ সামনে নিয়ে এসেছে। এই মহামারীতে এমএসএমই খাত লোকসানে পড়েছে বেশি। শ্রমঘন খাত হিসেবে মানুষের রোগ-ব্যাধির অভিঘাত এই খাতেই বর্তেছে বেশি।


করোনাভাইরাসের বিস্তার ঠেকাতে ওষুধ খাত ছাড়া আর যেসব উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে (যেমন লকডাউন, সামাজিক দূরত্ব ও কোয়ারেন্টিন), এগুলোর কারণে বিশ্বজুড়ে এক অভূতপূর্ব এবং নজিরবিহীন মন্দা ও কর্ম-শৈথিল্য সৃষ্টি হয়েছে। কোনো দেশ, অঞ্চল, মহাদেশ এই বৈশ্বিক ব্যাধির মরণ ছোবল থেকে মুক্ত নয়। বাংলাদেশ তো নয়ই।


অর্থনীতিবিদ, গবেষকপণ্ডিত, ব্যাংকার ও চিন্তাশীল মানুষ তাই অতিক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মধ্যম পর্যায়ের (এমএসএমই) উদ্যোক্তাদের ওপর বেশি ভরসা করেছেন। সবাই আশা করছেন, বাস্তব দৃষ্টিভঙ্গিসম্পন্ন এবং বিপদের মধ্যেও উঠে দাঁড়ানোর ক্ষমতাসম্পন্ন (Resilient) ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারাই পারবেন এই মন্দা, বাজার সঙ্কোচন, উৎপাদনহানি, কাঠামোগত বেকারত্ব (Structural Unemployment) এবং প্রচলিত উৎপাদন উপকরণের বাইরে গিয়ে পরিবেশবান্ধব, নারীবান্ধব, জ্বালানি সাশ্রয়ী, শ্রমঘন, সমবায়ী বা সম্মিলিত উদ্যোগ কাঠামো এবং উদ্ভাবনিমূলক প্রযুক্তির মাধ্যম প্রচলিত মুনাফাসর্বস্ব উৎপাদনের পরিবর্তে বহুপক্ষীয়, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও সামাজিক ব্যবসায়ী-উদ্যোগের দিকে ঝুঁকতে।


এই ধরনের সম্মিলিত উদ্যোগে উৎপাদনে সামাজিক যৌথ অংশগ্রহণ এবং লাভ-লোকসান ও দায়দায়িত্বের সমবণ্টিত হিস্যার সুফল নিশ্চিতভাবে লাভ করা সম্ভব। মূল লক্ষ্য হবে করোনা-বিপর্যয়ে মাথা তুলে দাঁড়ানো এবং টিকে থাকার (Resilience and Sustainable) অগ্রাধিকার বিবেচনা। করোনাকালে যে হারে উপার্জনশীল মানুষ বেকার হয়ে গেছে এবং বড়-মাঝারি ছোট নির্বিশেষে উৎপাদনী উদ্যোগ মুখ থুবড়ে পড়েছে, তাতে নতুন বাস্তবতার সাথে সঙ্গতি রেখে নতুন ধরনের মূল্য-সোপান (Value Chain) গড়ে তোলা দরকার।


div class="fiverr-video-banner-warp" style="display:inline-block">

এখন থেকেই করোনাকালের এবং করোনা-পরবর্তী সঙ্কটের জন্য আমাদের তৈরি থাকতে হবে। টিকে থাকার মতো যে উদ্যোগই গৃহীত হোক না, লাভের সাথে সম্পৃক্ত করতে হবে সামাজিক দায়িত্ব, পরিবেশ রক্ষার ব্যবস্থা এবং মুনাফার সামাজিক সুবিচার বা যৌক্তিক বণ্টন নীতিকে; শ্রমের সাথে সম্পৃক্ত করতে হবে মেধাকে এবং শিল্প কাঁচামালের সাথে সম্পৃক্ত করতে হবে অব্যাহত গবেষণা ও উন্নয়ন (R&D) কার্যক্রমকে এবং রক্ষণশীলতা বাদ দিয়ে জেন্ডার সাম্য নীতিকে সম্পৃক্ত করতে হবে। সময় যতই সামনে এগোবে, ততই নারীর অবদান এবং উৎপাদনে রমণীয় হিস্যার প্রাসঙ্গিকতা বাড়তে থাকবে। তেমনি তথ্যপ্রযুক্তিসহ যোগাযোগ প্রযুক্তির ক্ষেত্রে যে নীরব বিপ্লব ঘটে গেছে, করোনা ও করোনা-পরবর্তী অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার কার্যক্রমে আধুনিক প্রযুক্তির সর্বোত্তম এবং সর্বাত্মক সদ্ব্যবহার করতে হবে।

অতি ক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র, মাঝারি ও মধ্যম শ্রেণীর উদ্যোক্তাদের এখন থেকেই টিকে থাকার ক্ষমতা অর্জন করতে হবে, যার মধ্যে থাকবে কৌশলগত প্রস্তুতি, গবেষণা এবং আজকের পর্যালোচনা থেকে আগামীকালের উপায় অন্বেষণ করা। ‘কোভিড-১৯’ এর জন্য কেউ আগাম কিছু জানত না বা প্রস্তুত ছিল না। এর অর্থ এই নয় যে, করোনাকালে দেখা দিতে পারে বা করোনা-পরবর্তী সময়ে হানা দিতে পারে, এমন সব বিপদ মোকাবেলার জন্য যথেষ্ট পরিমাণ ‘Resilience’-এর ব্যবস্থা রাখার প্রয়োজন নেই। টিকে থাকার উপায় কৌশল কেবল করোনাকালের মন্দা মোকাবেলার জন্যই নয়, ভবিষ্যতে এর অনিবার্য প্রতিক্রিয়া কিংবা এ ধরনের বিপদ মোকাবেলার জন্যও দরকার।


অতি ক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র, মাঝারি ও মধ্যম শ্রেণীর উদ্যোক্তাদের উপায়-কৌশলের ব্যবস্থা রাখতে হবে নেতৃত্বকে নতুন আঙ্গিকে সাজাতে, রাজস্ব জোগানে, ব্যবসায়ী উদ্যোগের কাঠামো পুনর্বিন্যাসে, আর্থিক ব্যবস্থাপনায়, পরিচালনাগত কৌশলে এবং অবশ্যই মূল্যসোপান ও সরবরাহ সোপানকে অক্ষত রাখার প্রয়োজনে। এই সোপানগুলো ভেঙে গেলে বা অসংলগ্ন হয়ে গেলে শ্রমিক-কর্মী, কাঁচামাল, প্রযুক্তি ও প্যাকেজিং- সব উপকরণ মজুদ থাকলেও উৎপাদন ব্যাহত হবে। ছোট ছোট উদ্যোক্তাদের উচিত উৎপাদন ব্যবস্থাপনার চলমান মডেলগুলোর পরিবর্তে ‘টেকসই’ মডেল উদ্ভাবন এবং তাকে অনুসরণ করা। করোনাকালে মানুষের স্বাস্থ্যহানি ও শারীরিক-মানসিক বিপর্যয় রোধে পুষ্টিকর বিশুদ্ধ ও নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন ও সরবরাহের নতুন নতুন মডেল গড়ে তোলার সুযোগ এবং অপরিহার্যতাও আছে। ক্রেতা বা গ্রাহকের প্রতি মমতা বা সহানুভূতি নতুন ব্যবসায়ী মডেলের অন্যতম ভিত্তি হতে পারে; যেমন হতে পারে পরিবেশবান্ধব ব্যবহার্য সামগ্রীর উদ্যোগ বা জৈবসার, পরিবেশ অনুকূল প্যাকেজিং ব্যবস্থা প্রভৃতি। গবেষকরা এটাকে বলছেন, উদ্যোক্তার পরিবেশ-সচেতনতা (Entrepreneurship Ecosystem)।

Post a Comment

0 Comments