প্রবাসী আয়ের ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা
এম এ খালেক
৩১ মে ২০২১,
তথ্যসূত্র: নয়াদিগন্ত
করোনার কারণে এক বছরেরও বেশি সময় ধরে বাংলাদেশের অর্থনীতি বিপর্যস্ত। অর্থনৈতিক প্রতিটি খাত মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। প্রবৃদ্ধির ধারা বিপন্ন। কিন্তু এর মধ্যেও বিস্ময়করভাবে প্রবাসী আয় দিনদিনই বাড়ছে। গত এপ্রিলে প্রবাসীরা ২০৬ কোটি ৭০ লাখ ডলার রেমিট্যান্স দেশে পাঠান। পরিসংখ্যান বলছে, চলতি অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে ৩৯ শতাংশ বেশি রেমিট্যান্স দেশে এসেছে।
রেমিট্যান্স বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের দ্বিতীয় বৃহত্তম উৎস। পণ্য ও সেবা রফতানি খাত থেকে এখনো সবচেয়ে বেশি বৈদেশিক মুদ্রা আহরিত হলেও রেমিট্যান্স জাতীয় অর্থনীতিতে তুলনামূলকভাবে বেশি অবদান রাখছে। পণ্য ও সেবা রফতানি করে যে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হয়; এর অন্তত ৩৫ থেকে ৪০ শতাংশ কাঁচামাল ও ক্যাপিটাল মেশিনারিজ আমদানিতে ফের বাইরে চলে যায়। ফলে জাতীয় অর্থনীতিতে এ খাতের মূল্য সংযোজনের হার ৬০ থেকে ৬৫ শতাংশ। অন্যদিকে জনশক্তি রফতানি খাত থেকে যে বৈদেশিক মুদ্রা আয় হয়; এর প্রায় পুরোটাই জাতীয় অর্থনীতিতে মূল্য সংযোজন করে। একই সাথে এ খাতে বিপুল মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে। বর্তমানে প্রায় সোয়া কোটি বাংলাদেশী বিদেশে কর্মরত। তবে করোনায় অন্য সব খাতের মতো জনশক্তি রফতানিও বিপর্যস্ত। ইতোমধ্যে প্রায় সাড়ে তিন লাখ প্রবাসী বাংলাদেশী দেশে ফিরতে বাধ্য হয়েছেন। অনেকে কর্মচ্যুত হয়ে বাইরে অবস্থান করছেন। অতিমারী শুরুর পর আশঙ্কা করা হয়েছিল, জনশক্তি রফতানি খাতে আয় অনেক কমে যাবে। কার্যত তা না হয়ে হয়েছে সম্পূর্ণ উল্টো। জনশক্তি রফতানি খাতের আয় বাড়ছে।
চলতি অর্থবছরের প্রথম মাসে (জুলাই, ২০২০) বাংলাদেশে ২৫৯ কোটি ৮২ লাখ ডলার প্রবাসী আয় হয়েছে। কোনো একক মাসে এটিই ছিল সর্বোচ্চ পরিমাণ রেমিট্যান্স আহরণ। ২০১৯-২০ অর্থবছরে মোট ১৮ দশমিক ৩২ মার্কিন ডলার রেমিট্যান্স এসেছে। ২০০৮-০৯ থেকে ২০১৭-১৮ অর্থবছর পর্যন্ত ১০ বছরে দেশের রেমিট্যান্স আহরণের পরিমাণ বেড়েছে ৩ দশমিক ৫৬ গুণ। এই সময়ে প্রবাসী বাংলাদেশীরা ১৩১ দশমিক ৮৬ বিলিয়ন ডলার দেশে পাঠিয়েছেন। বছরভিত্তিক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে প্রবাসীরা মোট এক হাজার ৫৩১ কোটি ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন। পরবর্তী বছরগুলোর মধ্যে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে এক হাজার ৪৯৩ কোটি ডলার, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে এক হাজার ২৭৬ কোটি ডলার, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে এক হাজার ৪৯৮ কোটি ডলার এবং ২০১৮-১৯ অর্থবছরে এক হাজার ৬৪২ কোটি ডলার রেমিট্যান্স পাঠান। বিশ্বব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, ২০২০ সালে বাংলাদেশ দুই বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স আয় করে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোর মধ্যে সপ্তম। এ বছর বিশ্বের নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে মোট ৫৪০ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স আসে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি রেমিট্যান্স আয় করে ভারত। দেশটি ৮৩ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স আহরণ করে। চীন ৬০ বিলিয়ন, মেক্সিকো ৪৩ বিলিয়ন, ফিলিপাইন ৩৫ বিলিয়ন, মিসর ৩০ বিলিয়ন, পাকিস্তান ২৬ বিলিয়ন, নাইজেরিয়া ও ভিয়েতনাম ১৭ বিলিয়ন করে এবং ইউক্রেন ১৫ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স আহরণ করে।
প্রবাসী বাংলাদেশীরা করোনাকালেও বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা পাঠিয়ে দেশের অর্থনীতিকে সচল রেখেছেন। প্রশ্ন হলো, এ সঙ্কটময় মুহূর্তেও প্রবাসী বাংলাদেশীরা এত বিপুল অর্থ দেশে পাঠাচ্ছেন কিভাবে? সরকার বলছে, সরকারের সঠিক নীতিমালার কারণেই প্রবাসী আয় বাড়ছে। বাংলাদেশ ব্যাংক প্রবাসী আয়ের উপর নগদ ২ শতাংশ হারে আর্থিক প্রণোদনা দিচ্ছে। এ ছাড়া রেমিট্যান্স পাঠানোর নীতিমালা আগের চেয়ে সহজ করা হয়েছে। ফলে প্রবাসীরা এখন ব্যাংকের মাধ্যমে রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছেন। হুন্ডির মাধ্যমে পাঠাচ্ছেন না। অর্থাৎ সরকারের উদার দৃষ্টিভঙ্গির কারণেই প্রবাসীরা বেশি করে অর্থ দেশে পাঠাচ্ছেন।
তবে অর্থনীতিবিদদের মতে, রেমিট্যান্স আহরণ বেড়ে যাওয়ার পেছনে বাংলাদেশ ব্যাংকের দেয়া ২ শতাংশ নগদ আর্থিক প্রণোদনা কিছুটা ভূমিকা রেখেছে বটে; কিন্তু আরো কিছু অদৃশ্য কারণ রয়েছে, যা রেমিট্যান্স প্রবাহে ইতিবাচক অবদান রাখছে। প্রবাসীদের মধ্যে যারা ইতোমধ্যে কর্মচ্যুত হয়ে দেশে ফিরেছেন তারা কর্মস্থলে সাময়িকভাবে সঞ্চিত অর্থ একযোগে দেশে নিয়ে এসেছেন। এ ছাড়া করোনায় স্থানীয় সুবিধাভোগীদের অর্থের চাহিদা বেড়ে গেছে। তাদের সেই চাহিদা মেটাতে প্রবাসীরা আগের তুলনায় বেশি অর্থ দেশে পাঠাচ্ছেন। অর্থনীতিবিদদের কেউ কেউ এসব দৃশ্যমান কারণের সাথে আরো কিছু কারণকে রেমিট্যান্স আয় বৃদ্ধির পেছনে নিয়ামক হিসেবে মনে করেন। তারা মনে করেন, করোনাকালীন রেমিট্যান্স বৃদ্ধির এ প্রবণতা কোনোভাবেই স্বাভাবিক অবস্থার নির্দেশক নয়। তারা বলছেন, বর্তমানে করোনায় বিশ্বব্যাপী হুন্ডি ব্যবসায় ধস নেমেছে। হুন্ডির মাধ্যমে দেশে অর্থ পাঠানো এখন আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ। তাই আগে যারা হুন্ডির মাধ্যমে দেশে অর্থ পাঠাতেন এখন তারা ব্যাংকিং চ্যানেলে সেই অর্থ পাঠাচ্ছেন। এ ছাড়া বাংলাদেশ থেকে বিদেশে পাচার হয়ে যাওয়া অর্থ আর আগের মতো প্রশ্নাতীতভাবে ব্যবহার করা যাচ্ছে না। অনেক দেশেই এখন বিনিয়োগ করা অর্থের উৎস সম্পর্কে জানতে চায়। ফলে বিদেশে পাচার করা অর্থ ব্যবহার ও বিনিয়োগে সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে। এ অবস্থায় অনেকেই পাচার করা অর্থ প্রবাসীদের মাধ্যমে রেমিট্যান্স আকারে দেশে পাঠাচ্ছেন। কাজেই বর্তমানে আমরা রেমিট্যান্স প্রবাহের যে ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা দেখছি; তা বেশিদিন স্থায়ী হবে না।
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে জনশক্তি রফতানি খাত গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। কিন্তু এ অবস্থা খুব বেশিদিন স্থায়ী হবে না। কারণ বাংলাদেশের অর্থনীতিতে তাৎপর্যপূর্ণ অবদান রাখলেও জনশক্তি রফতানি খাত জাতীয়ভাবে অবহেলিত। এ খাতের প্রায় পুরোটাই বেসরকারিভাবে নিয়ন্ত্রিত হয়। ফলে খাতটি বিবিধ সমস্যায় জর্জরিত। কিন্তু সেসব সমস্যা সমাধানে কোনো উদ্যোগ দৃশ্যমান নয়। আমাদের এ খাতের বড় সীমাবদ্ধতা হচ্ছে দেশের জনশক্তি রফতানি খাত কার্যত মধ্যপ্রাচ্যের ছয়টি মুসলিম দেশের ওপর নির্ভরশীল। এর মধ্যে শুধু সৌদি আরবেই কর্মরত আছেন মোট প্রবাসীর এক-তৃতীয়াংশ। দেশটিতে বর্তমানে ৩৯ লাখ বাংলাদেশী কাজ করছেন। বাংলাদেশ থেকে যারা বিদেশে কর্মসংস্থানে যান; তাদের বেশির ভাগই অদক্ষ। পেশাজীবী জনশক্তির হার খুবই কম। অথচ একজন পেশাজীবী যে আয় করতে পারেন ১০০ শ্রমিক তা পারে না। দক্ষ জনশক্তি এবং পেশাজীবীদের বেশি করে বিদেশে পাঠাতে হলে এ খাতের আয় আরো অনেকগুণ বাড়ানো সম্ভব।
স্মরণে রাখতে হবে, বর্তমান সময় প্রতিযোগিতার কাল। সৌদি আরব সম্প্রতি জনশক্তি আমদানির ক্ষেত্রে বেশ কিছু সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এগুলো একই সাথে ইতিবাচক এবং নেতিবাচক। সৌদি সরকার ৭০ বছর ধরে চলে আসা ‘কাফালা পদ্ধতি’ বাতিল করেছে। কাফালা পদ্ধতি হচ্ছে এক ধরনের বিধিনিষেধ। যারা সৌদি কাফালার মাধ্যমে দেশটিতে যান, তারা চাইলেও উল্লিখিত কাফালার নিয়ন্ত্রণের বাইরে কাজ করতে পারেন না। এমনকি দেশে আসা বা অন্যান্য ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে কাফালার মতামতই চূড়ান্ত। ফলে সৌদি আরবে গিয়ে শ্রমিকরা এক ধরনের দাসের মতো জীবন যাপন করতেন। এ প্রথা বাতিল করা হয়েছে। কাফালা প্রথা বাতিল হওয়ায় সৌদি প্রবাসী বাংলাদেশীরা সবচেয়ে বেশি খুশি হয়েছিলেন। কিন্তু সেই খুশি মিলিয়ে যেতে খুব একটা বেশি সময় লাগেনি। সৌদি সরকার ঘোষণা করেছে, সেখানে যারা কাজ করছেন এবং ভবিষ্যতে কাজের জন্য আসবেন তাদের ‘দক্ষতা উন্নয়ন’ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হবে। হিন্দিসহ মোট ছয়টি ভাষায় এ দক্ষতা উন্নয়ন পরীক্ষা দিতে হবে। দক্ষতা উন্নয়ন পরীক্ষায় বাংলা ভাষা অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। ফলে আগামীতে বাংলাদেশীরা সৌদি আরবে নিশ্চিতভাবেই বিপদে পড়তে যাচ্ছেন। মধ্যপ্রাচ্যে জনশক্তি রফতানিতে বাংলাদেশের প্রতিযোগী ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, থাইল্যান্ড, ফিলিপাইন প্রভৃতি দেশ দক্ষ জনশক্তি রফতানি করে। এসব দেশ আরবি শিখে যায়। ফলে ওই সব দেশের নাগরিকরা সহজে মধ্যপ্রাচ্যে তারা নিজেদের মানিয়ে নিতে পারেন। কিন্তু বাংলাদেশ থেকে যারা সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের অন্য দেশে কর্মসংস্থানের জন্য যান তাদের বেশির ভাগই অদক্ষ এবং ভাষাজ্ঞানহীন। ফলে তারা কর্মদাতার সাথে কোনো ধরনের দর কষাকষি করতে পারেন না। অনেকদিন ধরেই বিভিন্ন পর্যায় থেকে দক্ষ এবং পেশাজীবীদের বিদেশে কর্মসংস্থানে পাঠানোর ওপর গুরুত্বারোপ করা হলেও কর্তৃপক্ষ সে ব্যাপারে তেমন কোনো উদ্যোগ নেয়নি। বাংলাদেশী দূতাবাসগুলো জনশক্তি রফতানির ব্যাপারে তেমন কোনো কার্যক্রম নিয়েছে বলে শোনা যায় না। বাংলাদেশ থেকে যারা বিদেশে যান তাদের অনেকেই ভুয়া সনদ নিয়ে যান। পরবর্তীতে কাজ করতে গিয়ে প্রতারণা ধরা পড়ে। এতে দেশের সুনাম ক্ষুণ্ণ হয়।
জনশক্তি রফতানি খাতের আয় বাড়ানো এবং তা টেকসই করতে হলে অবশ্যই রাষ্ট্রীয়ভাবে উদ্যোগ নিতে হবে। একই সাথে জনশক্তি রফতানির নতুন নতুন ক্ষেত্র খুঁজে বের করতে হবে। হ
লেখক : অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার
0 Comments