করোনাকালীন আমাদের শিশু বাজেট
এম আফতাবুজ্জামান
২৭ মে ২০২১, ২০:২৭
তথ্যসূত্র: নয়াদিগন্ত
দরিদ্রতা, নদীভাঙন ও বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে এবং কর্মসংস্থানের আশায় গ্রাম থেকে হাজার হাজার মানুষ প্রতিনিয়ত রাজধানী ঢাকায় ভিড় করছে। ঢাকায় ৩০ হাজারের বেশি বস্তিতে প্রায় ৩৫ লাখ লোক বাস করে। এর সংখ্যা নিয়মিত বাড়ছে। দারিদ্র্য ও অসচেতনতার কারণে এ বিপুলসংখ্যক জনগোষ্ঠী তাদের সন্তানদের লেখাপড়া শেখাতে পারে না। দেশে শিশুশ্রমিকের সংখ্যা প্রায় ৭৯ লাখ। আরো রয়েছে লাখ লাখ পথশিশু। দীর্ঘমেয়াদি করোনা পরিস্থিতির কারণে আমাদের দেশের উল্লেখযোগ্যসংখ্যক শিশু শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বাংলাদেশের জনসংখ্যার প্রায় ৪৫ শতাংশ শিশু। যার ৪০ শতাংশ শিশু দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে। এসব শিশুর সার্বিক কল্যাণ, নিরাপত্তা প্রদান ও তাদেরকে সুনাগরিক করে গড়ে তোলার জন্য তৎকালীন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ২০১৫-১৬ অর্থবছরে পাঁচটি মন্ত্রণালয়কে সাথে নিয়ে শিশুদের জন্য আলাদা শিশু বাজেট প্রণয়ন করেন। এটি একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ ছিল। ২০১৫-১৬ অর্থবছর থেকে শুরু হওয়া শিশু বাজট ২০১৯-২০ অর্থবছরে এসে দ্বিগুণ হয়েছে এবং একই সাথে ১৫টি মন্ত্রণালয়কে এ প্রক্রিয়ায় যুক্ত করা হয়েছে। কিন্তু তৎকালীন অর্থমন্ত্রীর যে লক্ষ্য ছিল- ২০২০ সালের মধ্যে মোট জাতীয় বাজেটের ২০ শতাংশ শিশুদের জন্য বরাদ্দ করা, তা অর্জিত হয়নি। এখন সেই লক্ষ্য পূরণ করা সময়ের দাবি এবং সরকারের উচিত সে লক্ষ্যে কাজ করা।
উল্লেখ্য, এ বরাদ্দের বেশির ভাগ অর্থ সুবিধাভোগীদের চেয়ে প্রকল্প বাস্তবায়নে নিয়োজিত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতনভাতাদি ও অন্যান্য খাতে খরচ হয়। স¤প্রতি একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশ হয়, ২০১৫-১৬ অর্থবছরের শিশু বাজেটের ১০০ কোটি টাকা অলস পড়ে আছে। সরকারের সাতটি মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ে এ বাজেট খরচ করার কথা থাকলেও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলো যথাযথ পরিকল্পনা নিতে না পারায় কাজটি করতে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে। শিক্ষানীতি ২০১০-এর শিক্ষার উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য এর ২২ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘পথশিশুসহ আর্থসামাজিকভাবে বঞ্চিত সব ছেলে-মেয়েকে শিক্ষার আওতায় নিয়ে আসা’। আর এটি রাষ্ট্রের দায়িত্ব। এসডিজির লক্ষ্য অর্জনের- ১. দারিদ্র্য নিরসন; ২. নারী ও মেয়ে শিশুর ক্ষমতায়ন এবং জেন্ডার সমতা অর্জন; ৩. মানসম্মত শিক্ষা; ৪. সুস্থ জীবন নিশ্চিত করার ধারা বাস্তবায়নের জন্য এবং বাংলাদেশ সরকার গৃহীত রূপকল্প ২০২১, ৭ নং অনুচ্ছেদের ক, গ, ঘ, ঙ, চ উপধারা যথাক্রমে মৌলিক চাহিদা পূরণ, দারিদ্র্য নিরসন, খাদ্য ও পুষ্টিচাহিদা পূরণ, স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষা নিশ্চিত করার লক্ষ্য অর্জনে শিশুদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও পুর্নবাসন সময়ের দাবি। বিপুলসংখ্যক পথশিশু সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের উন্নয়ন মহাপরিকল্পনার বাইরে রেখে ২০৩০ সালের মধ্যে এসডিজির লক্ষ্য পূরণ সম্ভব নয়।
তাই পথশিশুসহ সব শিশুকে সমাজের মূল স্রোতে ফিরিয়ে এনে তাদেরকে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় সম্পদে পরিণত করতে সবার আগে সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে বাস্তব কর্মপরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। এর সাথে শিশুদের নিয়ে কার্যক্রম পরিকল্পনাকারী সংস্থাগুলোকে সংগঠিত করে জাতীয় পরিকল্পনা বাস্তবায়নে তাদের সম্পৃক্ত করতে হবে। এ ছাড়া শিশুদের পুনর্বাসনের জন্য আরো বাস্তব সেবামূলক কর্মসূচি বাড়াতে হবে। সব শিশুকে শিক্ষার আওতায় নিয়ে আসতে হবে, কমিউনিটি স্কুল, বস্তিকেন্দ্রিক স্কুল, উন্মুক্ত পথশিশু স্কুল, বিশেষ করে ড্রপ ইন সেন্টার (ডিআইসি), শেল্টার, মনোসামাজিক কাউন্সেলিং এবং কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ইত্যাদি তৈরি করতে হবে। আর এসব কার্যক্রম বাস্তবায়নে শিশুদের নিয়ে কাজে অভিজ্ঞ বিভিন্ন এনজিওকেও সম্পৃক্ত করতে হবে।
সরকারি গবেষণা সংস্থা বিআইডিএসের তথ্য মতে, এক বছরেরও অধিক সময়ের করোনা পরিস্থিতির কারণে দেশে নতুন করে দুই কোটির অধিক মানুষ দরিদ্র হবে। আর এর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাবে সুবিধাবঞ্চিত শিশু তথা পথশিশুর সংখ্যা ও শ্রমে নিয়োজিত শিশুর সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে। এর ফলে অনেক শিশু শিক্ষার আলো থেকে দূরে থাকবে, পাশাপাশি শিশুশ্রম ও বাল্যবিয়ের ঝুঁকিতে পড়বে লাখ লাখ শিশু, যা আমাদের সামগ্রিক উন্নয়নের জন্য বড় বাধা হয়ে দাঁড়াবে।
সম্প্রতি পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) ও ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্নেন্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (বিআইজিডি) এক যৌথ গবেষণার তথ্যে দেখা যায়, করোনাভাইরাসের দীর্ঘ অভিঘাতে ১৪ মাস শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার কারণে প্রায় ৬০ লাখ শিক্ষার্থী শিখতে না পারার ঝুঁকিতে আছে। আর এ সময়ে দেশের প্রাথমিকের ১৯ শতাংশ ও মাধ্যমিকের ২৫ শতাংশ শিক্ষার্থী শিখতে না পারার (লার্নিং লস) ঝুঁকিতে আছে। দীর্ঘমেয়াদি অবস্থায় তারা ঝরে পড়ার ঝুঁকিতেও আছে। কারণ তারা বর্তমানে মোটামুটি পড়াশোনার বাইরে রয়েছে।
দেশব্যাপী করোনা পরিস্থিতির কারণে প্রায় চার কোটি শিক্ষার্থীর শিক্ষাজীবন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এর পাশাপাশি শারীরিক ও মানসিক সমস্যায় পড়ছে, নারী ও শিশু-নির্যাতন বাড়ছে। টিভি, রেডিও ও অনলাইনে ক্লাস চালু হলেও প্রান্তিক পর্যায়ে এ সুযোগ কম। দুই দশকে যে অগ্রগতি হচ্ছিল তা স্তিমিত হয়ে পড়েছে। টেকসই উন্নয়ন লক্ষমাত্রা অর্জন কঠিন চ্যালেঞ্জে পড়ছে। তাই সময়োপযোগী পদক্ষেপ, প্রয়োজনীয় অর্থের সঙ্কুলান এবং প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়াতে হবে। যেহেতু করোনা পরিস্থিতি সহসা উন্নতি হচ্ছে না এবং এর সুদূরপ্রসারী প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ নেতিবাচক প্রভাব রয়েছে। সেহেতু পরিস্থিতি মোকাবেলা করার জন্য এবং আশু সুফল পাওয়ার জন্য আমাদের সম্মিলিত কিছু উদ্যোগ নেয়া সময়ের দাবি যা নিম্নে সুপারিশ আকারে পেশ করা হলো-
করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে উদ্ভ‚ত পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত পথশিশু, সুবিধাবঞ্চিত এবং অসহায় শিশুদের জন্য সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে পরিচালিত বিভিন্ন সহায়তা কার্যক্রম অব্যাহত রাখা।
নতুন দারিদ্র্যের শিকার জনগোষ্ঠীকে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের অধীন সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির (সোস্যাল সেফটি নেট) আওতায় আনতে হবে এবং এ জন্য প্রয়োজনীয় বরাদ্দ দিতে হবে।
শিশু অধিদফতরের কার্যক্রম দ্রুত শুরু করা।
শিশুসংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোর মধ্যে কাজের সমন্বয় ত্বরান্বিতকরণ।
শিক্ষাবঞ্চিত শিশুদের জন্য পুনরুদ্ধার প্রণোদনা কর্মসূচি নিতে হবে এবং এ জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দেরও ব্যবস্থা করতে হবে।
পথশিশু, সুবিধাবঞ্চিত এবং অসহায় শিশুদের জন্য পরিচালিত বিভিন্ন সহায়তা কার্যক্রম সমন্বয়ের জন্য সরকারি ও বেসরকারি সংস্থার সমন্বয়ে একটি মনিটরিং সেল গঠন করা।
পথশিশু, সুবিধাবঞ্চিত এবং অসহায় শিশু যাতে শিশুশ্রমে বা ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত না হয়, মাদকাসক্ত, বাল্যবিয়ে, যৌন হয়রানির ও পাচারের শিকার না হয় সে বিষয়ে সবার সর্তক দৃষ্টি রাখা এবং এ লক্ষ্যে সরকারি ও বেসরকারি যৌথ উদ্যোগে দেশব্যাপী কার্যক্রম হাতে নেয়া।
উপবৃত্তির সংখ্যা ও বাজেট বাড়ানো।
পথশিশু তথা সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের সংখ্যা নিরূপণের জন্য দেশব্যাপী জরিপ পরিচালনা করা।
শিক্ষার ঘাটতি পূরণ এবং পরিবর্তিত পরিস্থিতির জন্য সাথে শিশুদের খাপ খাওয়াতে পুনরায় স্কুল খোলার সময় ‘মিশ্র পদ্ধতি’ ব্যবহার করা যেতে পারে। সবোপরি-
জাতীয় বাজেটের ২০ শতাংশ শিক্ষা খাতে বরাদ্দ করা এখন সময়ের দাবি।
আজকের শিশুরাই আগামীর সম্ভাবনা তথা ভবিষ্যৎ কর্ণধার। তারা শারীরিক, মানসিক, স্বাস্থ্য, শিক্ষায়, চিন্তায়-চেতনায় ও মননে যত সমৃদ্ধ হবে জাতির ভবিষ্যৎ ততই শক্তিশালী হবে। আর তার জন্য চাই পর্যাপ্ত বরাদ্দ, প্রযুক্তিসমৃদ্ধ আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থা, প্রযুক্তিসমৃদ্ধ কমিউনিটি শিক্ষাকেন্দ্র এবং করোনাসহনশীল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।
লেখক : নির্বাহী পরিচালক, আপন ফাউন্ডেশন ও
সহসভাপতি, স্ট্রিট চিলড্রেন একটিভিস্টস নেটওয়ার্ক-
স্ক্যান বাংলাদেশ
aftabapon@gmail.com
0 Comments